Description
সখী রঙ্গমালা উপন্যাসটি রচিত হয়েছে দক্ষিণ সমতট অঞ্চলের দুশো বছরেরও আগেকার এক কিংবদন্তির আখ্যানকে উপজীব্য করে। উপাখ্যানের প্রথমেই লক্ষ করা যায়, উপন্যাসের নায়ক রাজচন্দ্রের প্রেমিকা নিচু জাতের নরকন্যা ‘রঙ্গমালা’র কাটা মুন্ডু নিয়ে রাজবাড়িতে হুলস্থূল। কাকপক্ষীর ডাকাডাকি। গল্পে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে হীরা দাসী, রাজচন্দ্রের স্ত্রী ফুলেশ্বরী রাই, দাপুটে মা সুমিত্রারা।
রঙ্গমালাকে নিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের অবয়ব। আমরা উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে একটু পড়ে দেখতে পারি। ‘…চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কিছুটা সুস্থির হয় ফুলেশ্বরী। এ স্বপ্ন, না বাস্তব, রঙ্গমালা মারা গেছে! সাধের দিঘি কাটতে গিয়ে মরণ হলো অভাগীর। কি বীভৎস মৃত্যু! কল্লা কেটে ফেলেছে পাষ- খাসবরদার চান্দা বীর, কর্তাঠাকুর রাজেন্দ্র নারায়ণের হুকুমে। এখন রঙ্গি মরলে রাইয়ের ফায়দা কি। সংসারজলে সে তো আজ শেওলার মতো ভাসছে। শিকড় গাড়ার দিন শেষ। রাইয়ের চোখে আবারো হু-হু করে কান্না আসে। যার জন্য ফুলেশ্বরীর এ সর্বনাশ, স্বামী থেকেও বিধবা, তার মরামুখ দূরে থাক, জিয়ন্তে তাকে সাধ মিটিয়ে দেখতে পারলো না! স্বপ্নে দেখলে যদি দেখা হয়, জলের বুকে তার ছায়া যদি সে হয়, তাহলে তো ফুলেশ্বরী রাই বছর খানেক আগে রঙ্গমালাকে দেখেছে। এখনো তার বাঁধভাঙা হাসি দূর থেকে কান্নার মতো রাতের বাতাসে ভেসে আসে।’ পুরো রচনা জুড়ে যেন নির্মিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত হওয়া বাঙালি নারীজীবন।
শাহীনের রচিত এ-আখ্যান পাঠ করার সময় এর গল্প খুঁজে বের করার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় না। উপন্যাসের পরিচ্ছন্ন জমিন পাঠককে স্বস্তি দেয়। তেমনি আঞ্চলিকতার নিখুঁত মিশ্রণ একটা ভালো লাগা তৈরি করে যায়।। তাঁর ভাষায়: হীরা তো কেনা বান্দি – হুকুমের দাস। তবু শাদির কথা শুনে ফুলেশ্বরীর বাবা কালীচরণ গুহর দ্বারে মাথা কুটিতে বাকি রাখে নাই, এ বিয়া দিয়েন না, দিয়েন না। আমনে কি কানে তুলা ভরি থুইছেন?… আঁই এক্কান কতা কই – মাইয়্যাগারে কাডি গাঙ্গে ভাঁসাই দ্যান।’
শাহীন তাঁর রচনাকে শাসন করে চলেন। আয়েশী ঢঙে গল্প বলে যান। পাঠক ইচ্ছেমত বিরতি নিয়ে আবার লেখায় ঢুকে যেতে পারেন। তেমনি তাঁর উপন্যাসের কোথাও কোথাও আনন্দ এসে খেলা করে। তৃপ্তি দেয়। তিনি লিখেছেন, …শাশুড়িমা সুমিত্রাকে একনজর দেখেই হীরার ব্কু থেকে পাষাণ নামে। স্বামী যেমনই হোক, মা মরা মেয়েটা নতুন করে মায়ের কোল পেল। মাটিতে থুলে সাপে কাটবে, জলে নামালে কুম্ভীরে কামড়াবে – নম নম করে পুত্রবধূকে বড় করেন তিনি। বউও বাপের বাড়ির মতো পাখপক্ষীর নাওয়া-খাওয়া, বিয়েথা নিয়ে মেতে থাকে। আজ দোয়েলের তো বাজপাখির বা টিয়ার। রঙিন ফুল-পাতা দিয়ে খাঁচার বাহারি সাজ, পাখিতে পাখিতে মালাবদল, মিষ্টিমুখ-বাদামে বিয়ের উৎসব আর শেষ হতে চায় না। তাতে বাগড়া দিলে শাশুড়ির সঙ্গে বউ ঝুলাঝুলি করে, নয়তো গোসসা করে গাছে উঠে যায়। থালায় দুধ-ভাত মেখে নিচ থেকে কাকুতি-মিনতি করে মা সুমিত্রা। ওদিকে রাই তরতরিয়ে উঠে পড়ে গাছের মগডালে। ডাল-পাতায় লুকিয়ে পাখির গান গায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে। ঋতুস্রাব হওয়ার পরে বাধে গ-গোল। বউয়ের মতি ফেরাতে পারেন না শাশুড়িমা। রাতে ছেলের ঘরে এক দুয়ার দিয়ে ঢুকিয়ে দেন তো বউ অন্য দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসে। অগত্যা দরজায় পাহারা বসানো হয়।’
শাহীন আখতার কথাসাহিত্য নিরীক্ষার চেষ্টায় সফল বলা যাবে। কোনো পূর্বসূরির সাথে তুলনা না করেও তাঁর সাহিত্য নিয়ে সহজেই কথা বলা যায়। সাহিত্যের মান অক্ষুণ্য রেখেও প্রতিষ্ঠিত কিছু শব্দকে তিনি সরলভাবে এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। শতভাগ লেখক সত্তা থাকলে দুশো বছরের পুরনো আটপৌরে এক আখ্যানকে কেন্দ্র করে এমন শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করা সম্ভব।
রঙ্গমালাকে নিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের অবয়ব। আমরা উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে একটু পড়ে দেখতে পারি। ‘…চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কিছুটা সুস্থির হয় ফুলেশ্বরী। এ স্বপ্ন, না বাস্তব, রঙ্গমালা মারা গেছে! সাধের দিঘি কাটতে গিয়ে মরণ হলো অভাগীর। কি বীভৎস মৃত্যু! কল্লা কেটে ফেলেছে পাষ- খাসবরদার চান্দা বীর, কর্তাঠাকুর রাজেন্দ্র নারায়ণের হুকুমে। এখন রঙ্গি মরলে রাইয়ের ফায়দা কি। সংসারজলে সে তো আজ শেওলার মতো ভাসছে। শিকড় গাড়ার দিন শেষ। রাইয়ের চোখে আবারো হু-হু করে কান্না আসে। যার জন্য ফুলেশ্বরীর এ সর্বনাশ, স্বামী থেকেও বিধবা, তার মরামুখ দূরে থাক, জিয়ন্তে তাকে সাধ মিটিয়ে দেখতে পারলো না! স্বপ্নে দেখলে যদি দেখা হয়, জলের বুকে তার ছায়া যদি সে হয়, তাহলে তো ফুলেশ্বরী রাই বছর খানেক আগে রঙ্গমালাকে দেখেছে। এখনো তার বাঁধভাঙা হাসি দূর থেকে কান্নার মতো রাতের বাতাসে ভেসে আসে।’ পুরো রচনা জুড়ে যেন নির্মিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত হওয়া বাঙালি নারীজীবন।
শাহীনের রচিত এ-আখ্যান পাঠ করার সময় এর গল্প খুঁজে বের করার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় না। উপন্যাসের পরিচ্ছন্ন জমিন পাঠককে স্বস্তি দেয়। তেমনি আঞ্চলিকতার নিখুঁত মিশ্রণ একটা ভালো লাগা তৈরি করে যায়।। তাঁর ভাষায়: হীরা তো কেনা বান্দি – হুকুমের দাস। তবু শাদির কথা শুনে ফুলেশ্বরীর বাবা কালীচরণ গুহর দ্বারে মাথা কুটিতে বাকি রাখে নাই, এ বিয়া দিয়েন না, দিয়েন না। আমনে কি কানে তুলা ভরি থুইছেন?… আঁই এক্কান কতা কই – মাইয়্যাগারে কাডি গাঙ্গে ভাঁসাই দ্যান।’
শাহীন তাঁর রচনাকে শাসন করে চলেন। আয়েশী ঢঙে গল্প বলে যান। পাঠক ইচ্ছেমত বিরতি নিয়ে আবার লেখায় ঢুকে যেতে পারেন। তেমনি তাঁর উপন্যাসের কোথাও কোথাও আনন্দ এসে খেলা করে। তৃপ্তি দেয়। তিনি লিখেছেন, …শাশুড়িমা সুমিত্রাকে একনজর দেখেই হীরার ব্কু থেকে পাষাণ নামে। স্বামী যেমনই হোক, মা মরা মেয়েটা নতুন করে মায়ের কোল পেল। মাটিতে থুলে সাপে কাটবে, জলে নামালে কুম্ভীরে কামড়াবে – নম নম করে পুত্রবধূকে বড় করেন তিনি। বউও বাপের বাড়ির মতো পাখপক্ষীর নাওয়া-খাওয়া, বিয়েথা নিয়ে মেতে থাকে। আজ দোয়েলের তো বাজপাখির বা টিয়ার। রঙিন ফুল-পাতা দিয়ে খাঁচার বাহারি সাজ, পাখিতে পাখিতে মালাবদল, মিষ্টিমুখ-বাদামে বিয়ের উৎসব আর শেষ হতে চায় না। তাতে বাগড়া দিলে শাশুড়ির সঙ্গে বউ ঝুলাঝুলি করে, নয়তো গোসসা করে গাছে উঠে যায়। থালায় দুধ-ভাত মেখে নিচ থেকে কাকুতি-মিনতি করে মা সুমিত্রা। ওদিকে রাই তরতরিয়ে উঠে পড়ে গাছের মগডালে। ডাল-পাতায় লুকিয়ে পাখির গান গায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে। ঋতুস্রাব হওয়ার পরে বাধে গ-গোল। বউয়ের মতি ফেরাতে পারেন না শাশুড়িমা। রাতে ছেলের ঘরে এক দুয়ার দিয়ে ঢুকিয়ে দেন তো বউ অন্য দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে আসে। অগত্যা দরজায় পাহারা বসানো হয়।’
শাহীন আখতার কথাসাহিত্য নিরীক্ষার চেষ্টায় সফল বলা যাবে। কোনো পূর্বসূরির সাথে তুলনা না করেও তাঁর সাহিত্য নিয়ে সহজেই কথা বলা যায়। সাহিত্যের মান অক্ষুণ্য রেখেও প্রতিষ্ঠিত কিছু শব্দকে তিনি সরলভাবে এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। শতভাগ লেখক সত্তা থাকলে দুশো বছরের পুরনো আটপৌরে এক আখ্যানকে কেন্দ্র করে এমন শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করা সম্ভব।