জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলেছিলাম - সঞ্জীব দ্রং

Boierhut Publications
Amazon Kindle Google Books

Description

ভূমিকা

বিখ্যাত গায়ক ভূপেন হাজারিকা একটি গান গেয়েছিলেন, ‘সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের, ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ যখন গুমরে কাঁদে আমি যেন তার নিরাপত্তা হই।’ ছাত্রজীবন থেকেই গানটি আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। আমি নিজেও এই গান গেয়েছি নানা অনুষ্ঠানে। এখনো সুযোগ পেলে এই গান গাই। আজ এতদিন পর আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রের অবস্থা দেখে, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষের অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের উপেক্ষা ও অবহেলা দেখে, মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা দেখে গানটির অর্থ আরো গভীরভাবে আমাকে ভাবায়। আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘কথা ছিল প্রত্যেককে দেখাব অনিন্দ্য সূর্যোদয়, পায়রা উড়িয়ে দেব মেঘের কিনারে।’ সেটি আর হয়নি।
আমি নিয়মিত লেখালেখির জগতে আসি ১৯৯৩ সালের পর। ১৯৯৪ সালে আমি নিয়মিত কলাম লিখি। কলামের নাম ‘আদিবাসী মেয়ে’। ওই কলামগুলো নিয়ে বই বেরিয়েছে এবং বইটির চতুর্থ সংস্করণ হয়তো শেষ হয়ে গেছে। অবশ্য নব্বইয়ের শুরুতেই আমি আদিবাসী অধিকার নিয়ে লেখা আরম্ভ করি। আমার লেখা পড়ে, গ্রামের দূর থেকে বাবা চিঠি লিখেছেন আতঙ্কিত হয়ে, আমি যেন সংখ্যালঘু মানুষের দুঃখকষ্টকে নিয়তি বা ভাগ্য বলে মেনে নেই। প্রিয় সন্তানের প্রাণের কথা চিন্তা করে, আর দেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে বাবা চিঠি লিখেছিলেন। তার অভিজ্ঞতা ও ধারণা হলো, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা এখানে সহজ নয়, নিরাপদও নয়। আমি বাবাকে বলতাম, বোঝাবার চেষ্টা করতাম আমি যা বলছি ও লিখছি সব মানুষের অধিকারের অংশ, মানবাধিকারের অংশ। তিনি নিশ্চয়ই তাতে শান্তি পেতেন না। আমাদের রাষ্ট্র, তার সরকারসমূহের নিষ্ঠুর চরিত্র, রাজনীতির অন্ধকার দিক, ন্যায়বিচারের চেহারা, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি দেখে বাবা চেয়েছিলেন তার সন্তান ‘সংখ্যালঘু’ সমাজের একজন হিসেবে এই দুঃখকষ্ট ও বঞ্চনার বেদনাকে ‘নিয়তি’ হিসেবেই নীরবে মেনে নিয়ে সহজ সুন্দর জীবনযাপন করুক, তবু ছেলেটি নিরাপদে বেঁচে থাকুক। সেটি আর হয়নি আমার জীবনে। ২০১০ সালের ২২ জানুয়ারি নেত্রকোনার রানীখংয়ে যখন আমাকে আক্রমণ করা হলো, আমার বাবার কথা মনে পড়ল। কত কিছুই তো হতে পারতো সেদিন। আমার মৃত্যু হতে পারতো অথবা চিরতরে আমাকে হয়তো বা মেরে পঙ্গু বানাবার নির্দেশ ছিল। জীবনে হয়তো কিছু পুণ্যের কাজ করেছিলাম, তাই সেদিন বেঁচে ফিরে এসেছিলাম। মনে পড়ে, এই জীবনে অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। একদিন কোনো এক আদিবাসী গ্রামে গেছি, অচেনা একজন মাঝবয়সী নারী এসে বললেন, তুমি আমার এই উপকার করেছিলে এত বছর আগে। ওই নারীর চোখ ছলছল। এইসব মায়াভরা মানুষদের দূরের নীরব আশীর্বাদেই হয়তো আমার বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি সেদিন। তারপরেই আমার ওই কলাম, ‘আমি জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলেছিলাম’ লিখেছিলাম প্রথম আলো’তে।
এই বইয়ে প্রকাশিত সকল লেখাই বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো’তে। এজন্য কিছু কিছু বিষয় পুনরাবৃত্তির মতো মনে হবে। প্রিয় পাঠক পড়ার সময় নিজগুণে তা বুঝতে পারবেন। বইটি প্রকাশের সময় এবং কলাম লেখার সময় তুলি লাবণ্য ম্রং, মহতী রেমা ও পিয়া দফো প্রম্নফ দেখে ও নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সূচীপত্র প্রকাশনীর কর্ণধার সাঈদ বারী নানাভাবে বইটি প্রকাশে উৎসাহিত করেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এই জীবনে কত মানুষের কাছে ঋণ আমার, ভালোবাসার, মমতার, সঙ্গে থাকার, পাশাপাশি পথচলার আর সমর্থনের। রবীন্দ্রনাথের মতো আমিও তো সবার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছি। ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ’, বলেছি।
আমাদের জন্মভূমি, এই দেশ কত সুন্দর। আমাদের গ্রামগুলো কত সুন্দর। নদী, পাহাড়, সবুজ ধানের ড়্গতে কত সুন্দর। এ দেশের মানুষের মনে বড় বেশি আবেগ। মায়াভরা প্রাণচঞ্চল কত মানুষ এখানে। কত সামান্যতেই এ দেশের মানুষেরা খুশি। কত আনন্দ তাদের মনে। এখানে আমরা যদি জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার আয়োজন করতে পারতাম, প্রিয় দেশটি আরো কত সুন্দর হয়ে উঠতো? মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘এ জীবন মরম্নসম ছিল গো, তুমি সেথা আনিলে বসšত্ম, বুঝিলাম ধরণীতে রয়েছে, আলো গান মাধুরী অনšত্ম।’ এত মাধুরী, আলো-হাসি-গান ছেড়ে কোথায় যাব আমি? সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
সঞ্জীব দ্রং
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

Similar Products

7569017142645226039