Description
যার কথা বলতে বসেছি সেই মানুষটি বহু পুরোনো এক হারকিউলিস সাইকেলে চেপে চলেছে একা একা। একাই বা হবে কেন, তমালী, শ্যামলী, চাঁদমুখী, সূর্যমুখী, রৌদ্রমুখী, জেবুন্নিসা, মীরাবাঈ থেকে কুলছুম, রুমি ঝুমি—কতজন, কত পিঙ্গল আঁখির কন্যারা চলেছে তার সঙ্গে। তাকে সেই সব পিঙ্গল আর কালো চোখেরমণির যুবতী, বালিকা, কিশোরী, সুস্তনী সুনিতম্বিনী কন্যারা, সেইসব কিশোরী, সদ্যযুবতী, পরিপূর্ণ যুবতী, শ্যামলা, কেউ গৌরী, দীর্ঘাঙ্গী, অধিকাঙ্গী কন্যারা যেন তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে ক্রমাগত। তার হারকিউলিস এখন বুড়ো হয়ে ঝরঝরে। কানুনগো হয়ে মেদিনীপুরে হল্কা ক্যাম্পের চাকরিতে গিয়ে সাইকেলটি কিনতে হয়েছিল। তখনই ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড, বছর তিনের পুরোনো, সস্তা পড়েছিল অনেক। মানুষটি চলেছে সেই হারকিউলিসের প্যাডেল ঘুরিয়ে, একা যতদূর যাওয়া যায়। দিগন্ত ছাড়িয়ে যতদূর সেই কন্যাডিহি। সে দিগন্তের দিকে চলেছে ছাড়িয়ে কন্যাডিহির দিকে যাবে বলে। লোকটি পশ্চিম মেদিনীপুরের ইয়াসিন পাঠান হতে পারে, আবার মালদহের গোপাল লাহা হতে পারে। আবার এদের কেউ না হওয়াই তার পক্ষে সম্ভব। অন্য আর একজন, যাকে আমরা কেউ চিনি না। অচেনা কত মানুষ গৌড়, আদিনা থেকে পুরোনো নীলকুঠি, সাহেব বাড়ি, জমিদার বাড়ি, পুরোনো নদীখাত থেকে পুরোনো পৃথিবীর গন্ধ নেয়। সেই গন্ধে ফেরা আছে, ক্রমাগত ফেরা। ফিরতে ফিরতে যেন পৃথিবীর জন্মের কাছে ফেরা যায়। সে তার মাতৃগর্ভে যেন ফিরে যায় স্বপ্নে আর কল্পনায়। ভাসতে থাকে অনন্ত সমুদ্র জলে। কল্পনাই তার স্বপ্ন। স্বপ্নই তার স্মৃতি। তার স্মৃতি সরণি ধরে আমাদের এই যাত্রা। আমাদের এই কাহিনি–কথন। কাহিনি তো স্মৃতিই। সেই স্মৃতির দিকে নিরন্তর যাত্রা মানুষের। বয়স যত বেড়ে যায়, স্মৃতির পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যায়, সেই পথ কোনো এক কন্যাডিহির কন্যাদের দিকে চলে যায়, জাহ্নবী দাসীর আট কন্যার দিকে যেতেই থাকে। সে সেই পথ ধরে ফিরে যায়, যেতেই থাকে বনে বাদাড়ে ফেলে আসা অতি, পুরাতন অতীতে। একটি মানুষ এখন এই শীতের দুপুরে প্রাচীন রাজধানী গৌড় চলেছে। তার জন্য অপেক্ষা করে আছে লোটন মসজিদের পাশে একটি তমাল গাছের নীচে জেবুন্নিসা। না, তার নাম তমালী। সে বলেছিল, সে ছিল হয়তো বা ইরানি বালিকা, মরুদেশ থেকে লুট করে আনা কন্যা, ক্রীতদাসী, তা থেকে জেবুন্নিসা। সে বলেছিল, গুরু সেবায় যাত্রা করা অষ্ট কন্যারও সে একটি হতে পারে, কোথা থেকে সে কোথায় এল, কোন সময় থেকে কোন সময়ে তা তার জানা নেই।